শূন্য হাতে পূর্ণ মনোবল, একাগ্রতা, নিষ্ঠা এবং দৃঢ়প্রত্যয়কে সম্বল করে কর্মজীবনে অর্জন করেছেন অসাধারণ সাফল্য। স্ব-কর্মসংস্থানের মাধ্যমে উপনীত হয়েছেন সাফল্যের শীর্ষে। যিনি বিশ্বাস করেন ব্যর্থতায় হতাশ হতে নেই, কোনো কোনো ব্যর্থতা জীবনকে সফল ও সার্থক করে তোলে। ছোট দিয়ে শুরু করলেও লক্ষ্য থাকতে হবে বড়। প্রিয় পাঠক, এতক্ষণ যাঁর কথা বলছি তিনি হলেন শিল্প-বাণিজ্য জগতের প্রোজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব, আজাদ প্রোডাক্টস এর চেয়ারম্যান এবং এমডি, রত্নগর্ভা মা পুরস্কার প্রবর্তক মোঃ আবুল কালাম আজাদ। যাঁকে সবাই চেনেন কর্মনিষ্ঠ, দৃঢ় এবং দূরদর্শী চিন্তার দৃঢ়চিত্ত ব্যক্তিত্ব হিসেবে।
অতুলনীয় জীবন সংগ্রামী এবং সফল ও সার্থক জীবন নির্মাতা আবুল কালাম আজাদের জীবনের গল্পও বৈচিত্রপূর্ণ। তিনি ১৯৫৪ সালের ২০ সেপ্টেম্বর চাঁদপুর জেলার ফরিদগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মরহুম মৌলভী আবুল হোসেন এবং মাতা সালেহা বেগম। মা ইন্তেকাল করেন আবুল কালাম আজাদের ৭ বছর বয়সে। পিতা ছিলেন একজন স্কুল শিক্ষক। বর্তমানে স্ত্রী বিলকিস জাহান এবং ১ ছেলে জিয়াউর রহমান আজাদ ও ২ মেয়ে বড় মেয়ে তানজিলা আজাদ, ছোট মেয়ে অনামিকা আজাদকে নিয়ে চলছে আবুল কালাম আজাদের সুখের সংসার।
চাঁদপুরে জন্মগ্রহণ করলেও আবুল কালাম আজাদের পরিবার পরবর্তীতে শরীয়তপুরে নতুন বসতি স্থাপন করেন। আজাদের জীবন কখনও মসৃণ ছিল না। ছোটবেলায় মাতৃহারা শিশু, পথভ্রষ্ট হওয়াই ছিল স্বাভাবিক; কিন্তু তিনি হননি। তিনি শরীয়তপুর থেকে এসএসসি ও এইচএসসি পাস করেন। স্কুল-শিক্ষক বাবা চেয়েছিলেন, তাঁর মতো প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকতা পেশা গ্রহণ করুক ছেলে। শিক্ষকতা পেশার প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বাবাকে জানান এ পেশায় যুক্ত হতে তাঁর মন সায় দিচ্ছে না। বাবাকে ব্যবসার কথা বলেন, কিন্তু বাবা রাজি হননি। বাবার অমতে ১৮ টাকা পুঁজি নিয়ে এলাকায় নারকেলের ব্যবসা শুরু করেন। একদিন নারিকেলের নৌকা ডুবে যায়। বাবা জানতে পেরে বলেন, তোমাকে দিয়ে ব্যবসা হবে না। কিন্তু দৃঢ়চেতা আবুল কালাম আজাদ বলেন নারিকেলের নৌকা ডুবেছে, তাতে কি হয়েছে; আমার স্বপ্নত’ ডুবেনি!
পরবর্তীতে বাবাকে না জানিয়ে ১৯৭৩ সালে ঢাকায় চলে আসেন। লক্ষ্য ছিল জীবনে বড় হওয়া। কিন্তু তখন ঢাকায় তাঁর কোনো আত্মীয়-স্বজন ছিল না। সহায়-সম্বলহীন আবুল কালাম আজাদ নিজ গ্রামের একজন পরিচিত লোকের সাহায্যে ঢাকার মাতুয়াইলে একটি মধ্যবিত্ত পরিবারে লজিং মাস্টার হিসেবে থাকার সুযোগলাভ করলেন। থাকা-খাওয়ার বিনিময়ে পরিবারের বাচ্চাদের পড়ানোর দায়িত্ব পেলেন। এরপর রাজধানীর দিকে আরও একটু এগুলেন। পুরাতন ঢাকার হাজী ওসমান গনি রোডে নতুন করে থাকার ব্যবস্থা হলো। সেখানে থাকার পাশাপাশি শেখ বোরহান উদ্দিন কলেজে স্নাতক ক্লাসে ভর্তির সুযোগ লাভ করেন। সেখান থেকে গ্রাজুয়েশন ডিগ্রি নিয়ে শিক্ষাজীবন সমাপ্ত করেন।
পুরাতন ঢাকার যে বাসায় গৃহশিক্ষক হিসেবে ছিলেন, সে বাসায় অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী শাহীদাকে পড়াতেন। একপর্যায়ে তাঁর প্রতি শাহীদার দুর্বলতা অনুভব করেন। এলাকার মুরুব্বিদের মাধ্যমে শাহীদার মায়ের কাছে প্রস্তাব পাঠালে শাহীদার মা আবুল কালাম আজাদের তখনকার আর্থিক অবস্থা বিবেচনায় রাজি হননি। কিন্তু তাতেও তিনি হতাশ না হয়ে আরও দৃঢ়চেতা হন। ব্যবসার চিন্তা আরও দৃঢ় হয় তাঁকে বড় হতে হবে, অর্থ উপার্জন করতে হবে।
এরপর তিনি ঢাকা শহরের বিভিন্ন জায়গায় ঘোরাফেরা শুরু করলেন। মানুষ কীভাবে থাকছে, কীভাবে জীবন নির্বাহ করছে; তা জানার কৌতূহল ও আগ্রহ জাগল প্রবলভাবে। ভাবলেন পুঁজিতো নেই, তাই ছোট-খাটো কিছু দিয়েই তাঁকে ব্যবসা শুরু করতে হবে। গতানুগতিক ব্যবসা না করে অধিকতর নতুন কী ব্যবসা করা যায় বুঝতে কখনো সদরঘাট, কখনো কমলাপুর, কখনো বায়তুল মোকাররমে ঘোরাফেরা করতে লাগলেন। এরই মধ্যে একদিন স্টেডিয়ামের কাছে একটা লোককে পেয়ে গেলেন। সে স্টেডিয়ামের লোহার গেটের সাথে লম্বা করে দড়ি টানিয়ে পোস্টার বিক্রি করছে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পোস্টার দেখছিলেন, আর কান পেতে রেখেছিলেন পোস্টার ক্রেতা চলে যাবার পর দুই পোস্টার বিক্রেতার কথোপকথনে। তাদের কথাবার্তায় বুঝলেন, পোস্টার বিক্রির ব্যবসায়ে ভালো লাভ থাকে। তিনি চিন্তা করলেন, এ ব্যবসাই করতে হবে। কোথা থেকে পোস্টার এনে বিক্রি করে তা পোস্টার বিক্রেতাদের কাছ থেকে জানতে না পেরে কৌশলে তাদের পিছু নিলেন। অনেক চেষ্টার পর সফলও হলেন। জানতে পারলেন, পুরাতন ঢাকার জজকোর্ট সংলগ্ন এলাকার পোস্টার সরবরাহকারীদের কাছ থেকে পোস্টার কিনে এনে স্টেডিয়ামের সন্নিকটে বিক্রি করেন। তখন থেকে আবুল কালাম আজাদেরও পোস্টার ব্যবসা শুরু হলো। প্রথমে স্টেডিয়ামের ঐ সময়ের মোহামেডান গেইটে, আবার কখনো মকবুল নামে এক জনের সহায়তায় পোস্টার বিক্রির কাজ চালিয়ে যেতে থাকেন। কিছুদিন পর বায়তুল মোকাররমের ফুটপাতে শুরু হয় তাঁর মূল পোস্টার ব্যবসা। মজার ব্যাপার হলো সময়ের সাক্ষী হিসেবে স্টেডিয়ামের সে গেটটি আজও আছে, তার বিপরীত পাশে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে আজাদ সেন্টার ও আজাদ প্রোডাক্টস এর বিক্রয় কেন্দ্র ভবন। ভবনের ভেতরে অনেক সুদৃশ্য শো’রুম, বিভিন্ন ধরনের জিনিসপত্রে সাজানো নজরকাড়া দৃশ্য আবুল কালাম আজাদের সাফল্যের গৌরব গাথা প্রচার করছে। শূন্য থেকে শিখরে ওঠার গল্প। আজাদ প্রোডাক্ট, গ্রান্ড আজাদ হোটেল, এ টু জেড কম্পিউটার লিঃ সহ তাঁর পরিচালিত বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানের দুর্দমনীয় অগ্রগতি যা রূপকথার গল্পকেও হার মানায়।
শূন্য থেকে শিখরে উঠে আসা স্বমহিমায় উদ্ভাসিত কর্মসফল দৃঢ়প্রত্যয়ী ব্যক্তিত্ব মোঃ আবুল কালাম আজাদের সাথে সম্প্রতি ক্যাম্পাস পত্রিকার প্রতিনিধি গিয়াস উদ্দিন আহমেদ একান্ত আলাপচারিতায় মিলিত হন। কথা বলেন তাঁর সংগ্রামী জীবন সম্পর্কে, জানতে চান রূপকথার মতো তাঁর সাফল্যের গুপ্তকথা। তাঁদের সেই আলাপচারিতার উল্লেখযোগ্য অংশ মোহাম্মদ মোস্তফার অনুলিখনে এখানে সন্নিবেশিত হলো।
ব্যবসায়িক জীবনের শুরুটা কীভাবে হয়েছিল জানতে চাইলে সাফল্যেভরা জীবনের অধিকারী আবুল কালাম আজাদ বলেন বেঁচে থাকার তাগিদে অনেকেই অনেক কিছু করেন; হয়ত কেউ সাফল্য পান, কেউ পান না। বাবা স্কুল শিক্ষক ছিলেন; তিনি চেয়েছিলেন আমিও তাঁরই মতো স্কুল শিক্ষক হই। আমি উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দেয়ার পর রেজাল্ট বেরোনোর তিনমাস সময়ের মধ্যে স্থানীয় এক হাট থেকে অন্য হাটে নারকেলের ব্যবসা শুরু করি। সেখানে আমার ব্যবসায়ের হাতেখড়ি হয়; ব্যবসায়ে লাভ-লোকসান, পরিস্থিতি বোঝার প্রাথমিক অভিজ্ঞতা সঞ্চয় হয়। তখন কেন জানি মনে হয়েছিল, ব্যবসা করলে আমি ভালো করব। এখন বুঝতে পারছি, আমার সিদ্ধান্ত ভুল ছিল না; আমি মোটামুটি একজন ভালো ব্যবসায়ী হিসেবে সফলকাম হয়েছি।
জিরো থেকে হিরো হয়েছেন; আপনার সাফল্যের মূলে কী ছিল জানতে চাইলে আবুল কালাম আজাদ বলেন, আই লাভ কমিটমেন্ট। ব্যবসার জন্যও মিথ্যা বলি না। আরেকটা জিনিস পছন্দ করি, মানুষকে সময়মতো পেমেন্ট দিতে; কেউ যদি আমার কাছে টাকা পায়। সফলতার পেছনে এটাও একটা কারণ। আমারতো ধরুন পেপার, কেমিক্যাল, প্লেট, ইঙ্ক -এসবের বেশি প্রয়োজন পড়ে, আমরা সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে ফোন দিয়ে চাহিদা জানালেই তারা আমাদের মালামাল পাঠিয়ে দেন। কেউ কখনো বলে না, টাকা কবে দেবেন স্যার? কারণ তারা জানে, আমাকে কোনো মাল দিলে তার টাকাটা ঠিক সময়ে পেয়ে যাবে।
আজাদ প্রোডাক্টস এর বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলে আবুল কালাম আজাদ বলেন, প্রাথমিকভাবে ভিউকার্ড-পোস্টার দিয়েই ব্যবসা আরম্ভ করি। তবে যুগের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মানুষের অনেক কিছুই পরিবর্তন হয়। এখন কি আপনারা ভিউকার্ড কেনেন? আপনাদের পূর্বসূরিরা কিনেছেন, ঘনিষ্টজন কিনেছেন। আবুল কালাম আজাদ বলেন আমি ব্যাংকক, সিঙ্গাপুর থেকে পোস্টার আনতাম। পরবর্তী সময়ে এগুলো নিজেরাই দেশে তৈরি করি। সফলও হই। বিয়ের কার্ড, ক্যালেন্ডার, ডায়েরি প্রকাশে একসময় আজাদ প্রোডাক্টস এর নামই ছিল। কিন্তু প্রযুক্তির দ্রুত অগ্রগতির কারণে পার্সোনাল কার্ডগুলোর চাহিদা এখন অনেক কমে গেছে। তবে বিয়ের কার্ডের প্রচুর চাহিদা রয়েছে। এমন কী গ্রামগঞ্জেও বিয়ের কার্ডের ব্যাপক প্রচলন আছে। আর এক্ষেত্রে আজাদ প্রোডাক্টস এর চাহিদা সর্বাধিক।
ক্যারিয়ারের টার্নিং পয়েন্টটা কী জানতে চাইলে স্বপ্নচারী আবুল কালাম আজাদ বলেন তখন আমরা কাবা শরিফ, মদিনা শরিফ -এসব ছবি ব্যাংকক, সিঙ্গাপুর থেকে এনে বিক্রি করতাম। এখনো মনে আছে, সিক্স মিলিয়ন ডলার ম্যান, বায়োনিক ওম্যানের পোস্টার ছেলেমেয়েরা এত কিনত, মানে অকল্পনীয়ভাবে কিনত, এত পাগল ছিল, টিফিনের পয়সা, স্কুলের পয়সা বাঁচিয়ে বাঁচিয়ে পোস্টার কিনত। ওই সময় বেগম মমতাজ হোসেনের ‘সকাল সন্ধ্যা’ সিরিজ আরম্ভ হয়, তখন এর জনপ্রিয়তা ছিল তুঙ্গে; সেসময় শুধু বিটিভি ছিল, আর কোনো চ্যানেল ছিল না; ভাবলাম- বিদেশি সিরিয়ালের ভিউকার্ড-পোস্টার যদি এত চলে, তবে আমাদের দেশের সিরিয়ালের নায়ক-নায়িকাদের ভিউকার্ড, পোস্টারও ভালো চলতে পারে। আমার ভেতরে প্রশ্ন দেখা দিল। ভাবলাম, ফুটপাতের আবুল কালাম আজাদ! তুমি কীভাবে পীযূষ-আফরোজার, আফজাল-সুবর্ণার ছবি আনবে, তা কোত্থেকে আনবে? কীভাবে আনবে? আমি গ্রাম থেকে এসে কোনোরকম দাঁড়িয়েছি বায়তুল মোকাররমের সামনে, স্বপ্ন দেখছি- নায়ক-নায়িকাদের ভিউকার্ড যদি তৈরি করতে পারি, তাহলে কিছু একটা করতে পারব; সে স্বপ্নটাই একদিন বাস্তবে পরিণত করেছি। সেখান থেকেই জীবনের মোড় বা টার্নিং পয়েন্ট নির্ধারণ হয়ে গেছে আমার।
আপনার স্বপ্নকে মহীরূহে পরিণত করার গল্পটা বলবেন কী এমন প্রশ্নে আত্মপ্রত্যয়ী আবুল কালাম আজাদ বলেন, মতিঝিলের এজিবি কলোনিতে ভাড়া ছিলাম; ভাড়া চল্লিশ বা পঞ্চাশ টাকা হবে। সাথে একটা ছেলেকে নিলাম। ওকে নিয়ে হেঁটে হেঁটে পোস্টার বিক্রি করতাম। কখনো নিউ মার্কেট, বায়তুল মোকাররম, স্টেডিয়াম, গুলিস্তান, সদরঘাট। পোস্টার বিক্রি করতে করতে একদিন বায়তুল মোকাররম আসি। এসে দেখি, জুয়েলারির দোকানগুলো সব বন্ধ। কারণ জানি না, তখন দড়ি টাঙিয়ে, দড়িতে পোস্টার ক্লিপ দিয়ে ঝুলিয়ে বিক্রি করা আরম্ভ করলাম। মার্কেটের এক ছেলে এসে পিছে লাগল। বিক্রি করতে দেবে না, আপনার তো এখানে জায়গা নেই, কোত্থেকে আসছেন? কিন্তু আই এম ভেরি মাচ লাকি; এজন্য বলব, ওই সময়ে দেখি, এল রহমান জুয়েলার্সের মালিক আনিসুর রহমান দুলাল, বায়তুল মোকাররম ব্যবসায়ী সমিতির ১৩ বার প্রেসিডেন্ট। বলা যায়, ওনার দোকানের সামনে থেকেই আজকের আজাদ প্রোডাক্টস এর সৃষ্টি। দুই দিন আগেই উনি আমার কাছ থেকে মদিনা শরিফ, কাবা শরিফের দু’টি পোস্টার কিনে নিয়েছেন ৩৫ টাকা দিয়ে। ওটা যে ওনার দোকান ছিল জানতাম না। দুলাল ভাই দূর থেকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছেন। বাধাদানকারী ছেলেটার নাম ছিল চৌধুরী; ছেলেটাকে বললেন, তোমার কী সমস্যা? ও এখানে পোস্টার বিক্রি করছে, করতে দাও। সে বলল, স্যার ওনাকে তো আগে এখানে কখনো দেখি নাই, নতুন আসছে। ঠিক আছে, নতুন আসছে অসুবিধা কী, তারপরেও টাঙাতে দাও। উনি আমাকে পোস্টার টাঙিয়ে বিক্রি করতে দিলেন। তিন মাস কন্টিনিউ ওখানে পোস্টার বিক্রি করলাম। মনে হয়, জীবনের একটা ধাপ উঠে গেছি। ওই তিন মাসে ১৫-১৬ হাজার টাকা ক্যাপিটাল হয়ে গেছে! পরবর্তী সময়ে জানতে পারলাম, দোকান কেন বন্ধ ছিল? ওই সময়ে সরকার সোনার ওপর কী যেন ভ্যাট ধরেছিল, তার প্রতিবাদস্বরূপ ব্যবসায়ীরা ধর্মঘট ডেকেছিলেন অনির্দিষ্টকালের জন্য। যখন ধর্মঘট শেষ হলো, দোকানপাট খুলে গেছে; আমি আর পোস্টার টাঙিয়ে বেচতে পারি না। দুই দিন দাঁড়িয়ে ছিলাম দোকানের সামনে, কী করব বুঝতে পারছিলাম না, কোনো জায়গা নাই। এখানে ব্যবসা বেশ ভালোই করেছিলাম। প্রায় নির্দিষ্ট একটা ঠিকানা হয়ে যাওয়ার মতো। দুলাল ভাই তৃতীয় দিন ডাকলেন। বললেন, ভেতরে আসেন। ভেতরে গেলাম, বললেন আপনাকে আমি এই মুহূর্তে কোথাও বসতে জায়গা দিতে পারছি না, তবে এইখানে একটা খাম্বা দেখছেন না? ওইখানে কাঠের বক্স তৈরি করে বসতে পারেন। গুড আইডিয়া। ছোট্ট একটা কাঠের বক্স তৈরি করে দড়ি দিয়ে পোস্টার টাঙানোর ব্যবস্থা করলাম; যাতে দূর থেকে মানুষ দেখতে পায়। মনে হয় জীবনের দ্বিতীয় ধাপ পার করলাম। বায়তুল মোকাররমে বসে পোস্টার বিক্রি আরম্ভ করেছি।
তিনি বলেন, তখন একটা সিনে-ম্যাগাজিন ছিল তারকালোক। প্রকাশিত হতো আরেফিন বাদল ভাইয়ের সম্পাদনায়, সায্য্যাদ কাদিরও ছিল এ পত্রিকার সাথে। আরেকজন ভালো ক্যামেরাম্যান ছিল আল-মাজি ভাই। ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদে হঠাৎ করেই দেখি সকাল-সন্ধ্যা সিরিয়ালের শিমু-শাহেদের ছবি; মনে মনে বললাম, এঁদের ছবিইতো খুঁজতেছি। ভেতরে আফজাল-সুবর্ণার ছবি, রাজ্জাক ফ্যামিলির ছবি, আরো নায়ক-নায়িকাদের ছবি। মনে মনে ভাবছি, এঁদের ছবির যদি ভিউকার্ড, পোস্টার তৈরি করতে পারতাম -তাহলে কিছু করে ফেলতে পারতাম। যাঁরা সিক্স মিলিয়ন ডলারম্যান, বায়োনিক ওম্যানের পোস্টার কেনে; তারা হয়ত আমাদের দেশের শিমু-শাহেদ, আফজাল-সুবর্ণার পোস্টার, ভিউকার্ডও কিনবে। ছবি দেখছি আর ভাবছি, এ রকম ছবি যদি আমার থাকত -তাহলে ভিউকার্ড, পোস্টার তৈরি করতে পারতাম। তিন দিন ঘুম নাই; শিমু-শাহেদ কত বড় টিভি স্টার, এঁদের ছবি পাব নাকি? পাগল নাকি? মনে কত প্রশ্ন!
একদিন ভাবলাম এই পত্রিকার যে মালিক, তাঁর সঙ্গে যদি যোগাযোগ করি তাহলে মনে হয় ছবিগুলো কালেকশন করতে পারব। পত্রিকার অফিস ছিল নীলক্ষেত। তারকালোকের অফিসে গিয়ে দেখি বাদল ভাই নেই। ছিলেন সায্য্যাদ কাদির। বললেন, সম্পাদক সাহেবতো নেই। উনি এলে বলতে পারবেন। পরের দিন গেলাম, পাইনি। তৃতীয় দিন গিয়ে বাদল ভাইকে পেলাম। বললেন, আইডিয়া তো ভালো, একটু চিন্তা করে দেখি। আরো দুই দিন পর আসেন। দু’দিন পরে গেলাম। ছবিগুলো দিয়ে দিলেন। আমি অবাক! পোস্টার বিক্রি করতে করতে প্রায় লাখখানেক টাকার মালিক হয়ে গেলাম। তাই দেশি নায়ক-নায়িকাদের পোস্টার, ভিউকার্ড ছাপাতে বেগ পেতে হয়নি।
নায়ক-নায়িকাদের পোস্টার ছাপাতে যেয়ে কোনো ঝামেলার মধ্যে পড়েছেন কি এমন জিজ্ঞাসায় আবুল কালাম আজাদ বলেন, প্রাথমিক অবস্থায় কিছু অপ্রিয় ঘটনা ঘটলেও পরবর্তীতে সবাই আমাকে বন্ধু হিসেবে মেনে নেয়। ফলে দেশি নায়ক-নায়িকাদের পোস্টার বিক্রিতে ধুম পড়ে যায়। দেশে ছাপা খরচ বেশি বলে নায়ক-নায়িকাদের ভিউকার্ড তৈরির জন্য ব্যাংকক যাতায়াত শুরু করি। যে পোস্টারটা আগে আমরা এখান থেকে কিনতাম ১২-১৩ টাকা করে, ওখানে দাম তিন বাথ! তখন আমরা এক ডলার কিনতাম বাংলাদেশি ১৮ টাকায়, ওখানে ২০ টাকা। আমিই প্রথম বাংলাদেশে ভিউকার্ড বিদেশ থেকে প্রসেস করে নিয়ে আসি। দেশি জনপ্রিয় নায়ক-নায়িকাদের ভিউকার্ড তৈরি করে ধুমসে বিক্রি করি। কেউ হামলা-মামলা করেনি; যাদের ছবি তারাতো খুশি, তাদের প্রচার হচ্ছে। তবে তারকালোক পত্রিকার সাথে সংশ্লিষ্ট কেউ কেউ সেই ছবি সম্পর্কে আপত্তি তুলে আমার বিরুদ্ধে প্রচারণা শুরু করেন, যা প্রকারান্তরে আমার জন্য শাপে বর হয়েছিল।
আবুল কালাম আজাদ বলেন, এখানে একটা ভিউকার্ড প্রসেস করতে পাঁচ হাজার টাকা নেয়। অথচ সেই ভিউকার্ড তখন ব্যাংককে প্রসেস করেছি নিয়ার অ্যাবাউট ৪৫০ বাথ, ৫৫০ টাকায়। টার্নিং পয়েন্ট হলো, ব্যাংকক থেকে ভিউকার্ড এনে এখানকার প্রেসে ছাপালাম; সুন্দর ছাপা, চকচকে-ঝকঝকে। তখন ’৮২ এর ওয়ার্ল্ডকাপের পোস্টার চলছিল। এগুলো ব্যাংকক থেকে আনতাম। এই ধারণা থেকে আজকের ফুটবল ফেডারেশনের প্রেসিডেন্ট আমাদের প্রিয় স্টার কাজী সালাউদ্দিন, সালাম মোর্শেদী এঁদের পোস্টার তৈরি করি। ইন দ্য মিনটাইম জানতে পারলাম, তারকালোক পত্রিকায় ছবিগুলো আলমাজি ভাইয়ের তোলা। মাজি ভাই, আরেফিন বাদল, সায্য্যাদ কাদির, এ রকম পাঁচ-সাতজন মিলেই পত্রিকার মালিকানা। সাধারণত আমাদের দেশে ব্যবসা করলে মালিকানা নিয়ে যে রকম বিরোধ দেখা দেয়, এ রকম বিরোধ তাঁদের মধ্যেও দেখা দিয়েছে। মাজি ভাই ক্লেইম করলেন, আমার এই ছবিগুলো কেন আজাদকে দেয়া হলো? এ নিয়ে দারুণ উত্তেজনা। আমার সব ভিউকার্ড ছাপিয়ে কমেন্ট করা হলো- তথাকথিত বায়তুল মোকাররমের ফুটপাতের ব্যবসায়ী আবুল কালাম আজাদ এ ধরনের ভিউকার্ড তৈরি করে বাংলাদেশে অপসংস্কৃতি আমদানি করেছে। এদের শাস্তি হওয়া উচিত। চিত্রালী, সিনেমা, দৈনিক বাংলায় এভাবে যখন প্রচার হতে লাগল, আমার মনে হয় কপাল খুলে যেতে লাগল। বিনা পয়সায় এত প্রচার! ভিউকার্ড ছাপালাম পাঁচ হাজার, সাত হাজার করে। চকবাজারে দিলাম। কাড়াকাড়ি পড়ে গেল। এ বলে ভাই আমাকে ১০ হাজার দিয়েন। ও বলে ভাই আমাকে ২০ হাজার দিয়েন; অন্যজন বলে ভাই আমাকে ৩০ হাজার দিয়েন। আরেকজন বলে ভাই এক লাখ টাকা রাখেন, কাউরে দিয়েন না -সব আমারে দেন। সকাল থেকে টাকা নিয়ে তারা অপেক্ষা করত ভিউকার্ড কেনার জন্য।
আবুল কালাম আজাদ আরও বলেন, এরই মধ্যে চকবাজারের লোকেরা আমার প্রোডাক্ট নকল করা আরম্ভ করল। নায়ক-নায়িকারা সরাসরি আমাকে কিছু না বললেও পত্রপত্রিকায় আমার বিরুদ্ধে ব্যাপক লেখালেখি আরম্ভ হলে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট ও নাট্য আন্দোলনের পুরোধা, মুক্তিযোদ্ধা নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু ভাই একদিন আমাকে ডেকে বললেন, কী হইছে, ঘটনাটা কী? খুলে বললাম। রাগতঃস্বরে শিল্পীদের উদ্দেশ্য করে তিনি বললেন ব্যাটা, তোদের সৌভাগ্য আবুল কালাম আজাদ তোদের ভিউকার্ড তৈরি করছে। তোরা স্টার হয়ে গেছিস। জীবনে কখনো কল্পনা করতে পারছিস, বাংলাদেশে তোদের ভিউকার্ড হবে? আজাদকে ধন্যবাদ দে, গ্রেট আজাদ তোদের ভিউকার্ড তৈরি করছে, এই দেশে নতুন একটা সংস্কৃতি আরম্ভ করেছে। ভিউকার্ড সংস্কৃতি। দেখবি এই লোক একদিন অনেক বড় হবে। বাচ্চু ভাইয়ের সেই কথা এখনো আমার স্পিরিট, আমার মনোবল, আমার কর্মপ্রেরণা।
ব্যবসাক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করা যায় কীভাবে এমন প্রশ্নের জবাবে ব্যবসা জগতের জ্যোতিষ্ক আবুল কালাম আজাদ বলেন, জীবনে চলার বা প্রতিষ্ঠা লাভ করার পথে বাধা আসবে বিভিন্ন দিক থেকে; কিন্তু নিজ মেধা, বুদ্ধি, প্রতিভা দিয়ে সে বাধা অতিক্রম করতে হবে। এভাবে সকল অসুবিধা মোকাবেলা করে আমরা যদি সময়মতো সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারি, তাহলে সাফল্য অবধারিত।
যুব-সমাজের কাছে উজ্জ্বল ভাবমূর্তি এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকচারারের দায়িত্বলাভ সম্পর্কে তাঁর অনুভূতি জানতে চাইলে সৃজনশীল চিন্তা-চেতনার ধারক-বাহক, কীর্তিমান ব্যবসায়ী-শিল্পপতি আবুল কালাম আজাদ বলেন যুব-সমাজকে নিয়ে আমি অত্যন্ত আশাবাদী। শিক্ষার ব্যাপারেও আমি খুব আগ্রহী। আমি আমার মেয়েকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএ-তে ভর্তি করাতে পারিনি। কিন্তু আমি নিজে ঢাবি’র আইবিএ’র ভিজিটিং লেকচারার হিসেবে স্বচ্ছন্দে ক্লাস নিয়েছি, তরুণদের মাঝে নিজকে তুলে ধরেছি। তিনি বলেন যারা পাস করে বেরুচ্ছে, তারা জীবন সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা নিতে পারছে কিনা তা দেখতে হবে। কেননা যুব-সমাজের কাছে ভিশন ও মিশন দু-ই থাকতে হবে।
শূন্য থেকে উঠে আসার গল্প অনেক জায়গায় বলেছেন। ব্যাপারটি কীভাবে নিয়েছিল আপনার পরিবার, জানতে চাইলে আবুল কালাম আজাদ বলেন রেজানূর রহমান যখন আমাকে নিয়ে ইত্তেফাকের তারুণ্য পাতা করলেন, তখন আমার বড় মেয়ে ভিকারুননিসায় ক্লাস এইটে পড়ে। ও ক্লাসে গেল, বান্ধবীরা বলছে, তানজিনা, তোমার বাবা নাকি ফুটপাতে ব্যবসা করেছেন, এটা কি সত্য? মেয়ে তো ছোট মানুষ, এইটে পড়ে, বুঝবে কী? কাঁদতে কাঁদতে স্কুল থেকে চলে এসেছে। আমি অফিসে ছিলাম, ওর মা আমাকে ফোন দিয়ে বলল আপনি নাকি পত্রিকায় বলেছেন, ফুটপাতে ব্যবসা করেছেন; এসব বলার কোনো দরকার আছে? ওর বান্ধবীরা নাকি ওরে এসব বলেছে, ও কাঁদতে কাঁদতে বাসায় এসেছে। বলে, আমি আর স্কুলেই যাব না। ভিকারুননিসার প্রিন্সিপাল ছিলেন হামিদা আলী। তাঁকে ফোন করলাম। ঘটনাটা বললাম। তিনি আমার মেয়ের সঙ্গে কথা বললেন ঠিক আছে, কোন্ কোন্ মেয়ে তোমাকে এসব কথা বলেছে আমাকে কালকে স্কুলে এসে দেখিয়ে দেবে। পরদিন তিনি ক্লাসে গেলেন, আমিও গেলাম, লাবণীও আছে। ও বলল আপা, এই চারটা মেয়ে বলেছে। ওরা ভয়ে ভয়ে বলল আপা, আমরা তো সত্যিই বলেছি। পেপারে আছে, এই দেখেন। হামিদা আলী বললেন আমি অত্যন্ত আনন্দিত, খুবই খুশি; লাবণীর বাবা ফুটপাতে ব্যবসা করে আজকে এ পর্যায়ে আসতে পেরেছেন। মেয়েদেরকে আরো বললেন তোমরা কি জানো, আমার কোনো ছেলেমেয়ে নেই? আজ থেকে আজাদ আমার ছেলে। যে আজকে এই পর্যায়ে এসেও বলতে পারে, সে ফুটপাত থেকে ক্যারিয়ার বিল্ডআপ করেছে। লাবণী হলো আমার ছেলের মেয়ে-নাতনি। এটা আমার খুব ভালো লেগেছে।
সবার মাকে পুরস্কার দেন। আপনার মায়ের কথা মনে পড়ে কিনা জানতে চাইলে আবুল কালাম আজাদ বলেন মনে আছে, ছোটবেলায় অনেক দুষ্টু ছিলাম। বাবা ছিলেন বড় মাপের আলেম। ‘উলা পাস’, উলা পাস মানে মেট্রিক পাস। প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক ছিলেন। আমার জন্ম চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জে। মা-বাবার কাছ থেকে শুনেছি, লেখাপড়া করতাম না, বেশি বেশি দুষ্টুমি করতাম। তাই মা-বাবার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, সাত বছর বয়সেই আমাকে বাবার কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। আমাদের বাড়িতে দু’টি পুকুর, একটা দক্ষিণের পুকুর, আরেকটা উত্তরের পুকুর। উত্তরের পুকুরের পাড়ে দাঁড়িয়ে মা বলছিলেন, ‘হে আল্লাহ, তুমি আমার ছেলেকে দেখিও।’ আমিও মাকে হাত নাড়াচ্ছি। তখন তো মায়ের অনুভূতি অতটা বুঝতে পারিনি। বাবার সঙ্গে যাচ্ছি শরিয়তপুর। মায়ের সাথে সে-ই শেষ দেখা। পরবর্তী সময়ে মাকে আর দেখিনি। মা মারা গেছেন। আমার সাফল্য মা দেখে যেতে পারেননি। তাই মায়ের প্রতি ভালোবাসা ও মা-স্মৃতি প্রোজ্জ্বল রাখা এবং শিক্ষা-সমাজ-দেশ উন্নয়নের নেপথ্য শক্তি হিসেবে সকল মাকে অধিক সচেতন করার মানসে রত্নগর্ভা মায়ের সম্মাননা আয়োজন। রত্নগর্ভা মা অনুষ্ঠান করার পর আমি এ পর্যন্ত তিন’শ মায়ের সন্ধান পেয়েছি, যারা আমার মায়ের অভাব পূরণ করে দিয়েছেন। ছোটবেলায় মাকে হারিয়ে এক বুক শূন্যতা নিয়ে বাস করছিলাম, তা অনেকটা কাটিয়ে উঠেছি। এ কর্মসূচির মাধ্যমে গোটা দেশের রত্নগর্ভা মা’দের খোঁজ পাচ্ছি, তাঁদের সাথে পরিচয় হচ্ছে। অন্যান্য মায়েরা যারা ভবিষ্যতে এ সম্মাননা প্রাপ্ত হবেন তাঁরাও অনুপ্রাণিত হবেন, উজ্জীবিত হবেন।
রত্নগর্ভা মা’র ১৪তম আসর হয়েছে। শুরুর দিকে কী রকম রেসপন্স পেয়েছিলেন? এখন কেমন পান? এমন জিজ্ঞাসায় আবুল কালাম আজাদ বলেন, ২০০৩ সালে গ্র্যান্ড আজাদ হোটেলে আমরা প্রথম অনুষ্ঠান করি। প্রাথমিক পর্যায়ে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিলে ৫০-৬০ জনের মতো অ্যাপ্লাই করেছেন। ওখান থেকে বেছে ২৫ জনকে অ্যাওয়ার্ড দিই। এরপর যতই দিন যাচ্ছে, এর জনপ্রিয়তা, গ্রহণযোগ্যতা ততই বৃদ্ধি পাচ্ছে। এবার এসেছে ৮৫০টি। সন্তানরা তাঁদের মায়েদের নির্বাচিত করার জন্য এমনভাবে আবেদন করেন তাঁদের আবেদন-নিবেদন, অনুভূতি, বলার স্টাইল-তাঁদের মা যেন রত্নগর্ভা মা হন -এটা আমাকে দারুণভাবে অভিভূত করে। আমরা তাঁদের জন্য কিছু করতে পারি আর না-ই পারি, কিন্তু আমরা যখন পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিই রত্নগর্ভা মায়ের জন্য, তখন অনেকেই বলেছেন আপনার বিজ্ঞাপন পড়ে আমার সন্তানরা আমাকে আবার নতুন করে ভালোবাসতে শুরু করেছে।
অ্যাওয়ার্ড পাওয়ার পর তাঁদের পরিবর্তন এসেছে। গতবার একজন মা অ্যাওয়ার্ড পাওয়ার পর তাঁর অনুভূতি জানালেন বাবা, আমার তিন মেয়ে ও দুই ছেলে। মেয়েরা বড়, বিয়ে দিয়েছি; এক ছেলে ছোট, ইউনিভার্সিটিতে পড়ে; আরেকটা মেট্রিক পাস করার পর আর লেখাপড়া করেনি। নষ্ট হয়ে গেছে। নষ্ট কী রকম? বাবা, খারাপ বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে চলে। আসক্ত হয়ে গেছে, কত ডাক্তার দেখালাম, ভালো করতে পারলাম না। বাবা আপনাকে আমি কীভাবে ধন্যবাদ দেব? আপনি আমাকে রত্নগর্ভা মা অ্যাওয়ার্ড দেয়ার পর ছেলেমেয়ে, হাজব্যান্ডসহ চাইনিজ রেস্টুরেন্টে বসে সেলিব্রিটি অনুষ্ঠান করেছি। তখন যেটা খারাপ ছিল, মদটদ খেত, আড্ডা দিত, ওই ছেলেও ছিল। ও বলছে মা, তুমি আমাদের জন্য রত্নগর্ভা হয়েছ। তুমি তো আমাকে অনেক ডাক্তারের কাছে নিয়েছ, অনেক হাসপাতালে দেখিয়েছ, ভালো করতে পারোনি। আমি তোমার মাথায় হাত দিয়ে বললাম মা, আর খারাপ পথে চলব না। মাদকাসক্ত হব না। কারণ তুমি একজন রত্নগর্ভা মা। সেই মাকে গতবার আবার ফোন করেছিলাম; মা, তুমি কেমন আছ? বলেছেন বাবা, আপনাকে আমি কী বলব? জায়গাজমি, সম্পত্তি সব আপনাকে দিয়ে দেব। আপনি আমার জন্য যা করেছেন। বাবা আমার ছেলেকে বিয়ে করাইছি। এখন একটা নাতি হয়েছে, ছেলে পুরাপুরি সুস্থ। এসব শুনে আমার যে কী আনন্দ! আই লাইক ইট, আই লাভ ইট। লাখ লাখ টাকা খরচ করে এই অনুষ্ঠান করি কেন জানেন? আনন্দের জন্য। আমার দেশকে মনে হয় কিছু দিতে পারছি। এটা আমার আনন্দ, এতে আমি খুব খুশি। এমন একটা অনুষ্ঠান করি, মায়েদের নিয়ে অনুষ্ঠান! ইভেন এ অনুষ্ঠানে আমি আজাদ প্রোডাক্টস এর একটা বিজ্ঞাপন পর্যন্ত করি না। মায়েদের নিয়ে আমি বিজ্ঞাপন করব? প্রশ্নই আসে না।
স্বপ্নের ভুবনে বিচরণ সম্পর্কে আবুল কালাম আজাদ বলেন, ছোটবেলাকার আবুল কালাম আজাদের স্বপ্ন ছিল যদি একটা সাইকেল কিনতে পারতাম! ছোট্ট আবুল কালাম আজাদ থেকে, ছোট ছোট স্বপ্ন নিয়ে বড় হয়েছে সাফল্যের অভিযাত্রা। দুঃখ-দৈন্য, ব্যথা-বেদনা, হাসি-কান্না, আশা-নিরাশা সব মিলিয়েইত জীবন; একই ধারায় জীবন-নদী বয়ে চলে না। আমাকে নিয়েও এমন একটি পূর্ণদৈর্ঘ ফিল্ম তৈরি হচ্ছে, যাতে এ ধরনের বিষয়গুলো স্থান পাবে। সাফল্যের বাইরেও আমার পরিবার, ব্যবসা-বাণিজ্য, সামাজিক কর্মকান্ড, জীবন-যৌবন, প্রেম-ভালোবাসার কথাও থাকবে সেখানে। দেশের দর্শক-শ্রোতারা সেটি দেখে অনুপ্রাণিত হবে, উজ্জীবিত হবে, সন্দেহ নেই।
যুব-সমাজের প্রতি তাঁর পরামর্শের কথা বলতে গিয়ে যুব সমাজের স্বপ্নের মডেল আবুল কালাম আজাদ বলেন মানুষের জীবনের লক্ষ্য থাকে; তা সত্ত্বেও তার সামনে যদি আরও ভালো ও উন্নত কিছুর সম্ভাবনা দেখা দেয়, তাহলে গতানুগতিক দৃষ্টিভঙ্গি বাদ দিয়ে তাকে যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হবে। কোনোভাবেই হতাশ হলে চলবে না। ব্যর্থতা আসতে পারে, সেক্ষেত্রে তাকে জয় করাই হবে তরুণ সমাজের লক্ষ্য। তাই তাদের উদ্দেশ্যে বলব- যদি লক্ষ্য থাকে অটুট, বিশ্বাস হৃদয়ে হবে হবে দেখা, দেখা হবে বিজয়ে।
তথ্যসুত্র: ইন্টারনেট।