“উদ্যোক্তাদের সঙ্গে কথা বললে, বেশির ভাগের কাছ থেকে উত্তর পাওয়া যায়, ‘একেবারে শূন্য হাতে শুরু। উদ্যোক্তা হতে হলে পুঁজি লাগে না, আইডিয়াই সব।’ কিন্তু এর সঙ্গে দ্বিমত করলেন মাহমুদুল হাসান সোহাগ। বললেন, অবশ্যই পুঁজি লাগে।
” আমি শুরু করেছি ৫ হাজার কোটি টাকা নিয়ে! ”
শুনে ধাক্কা লাগে। তবে ব্যাখ্যা শুনে আবার স্বস্তি পাই। “এই টাকা ছিল আমার মস্তিষ্কে। কারণ, নিউরোসাইন্টিস্টদের ভাষ্য মতে, একটি কম্পিউটারের বিপরীতে একজন মানুষের মস্তিষ্কের দাম কমপক্ষে ৫ হাজার কোটি টাকার সমান। এই টাকা মাথায় রেখে নগদ ৬ হাজার টাকা নিয়ে আমার উদ্যোক্তা হওয়ার পথে যাত্রা শুরু”। তিনি মনে করেন, প্রতিটি মানুষই ৫ হাজার কোটি টাকার অধিকারী। কেবল এর ব্যবহার জানতে হবে।
মাহমুদুল হাসান সোহাগ একজন তড়িৎ প্রকৌশলী (ইইই, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়-বুয়েট)। বর্তমানে তিনি “অন্যরকম” গ্রুপের চেয়ারম্যান।
ভিন্ন ধারার শিক্ষার্থী তৈরির জন্য তিনি গড়ে তুলেছেন একাডেমিক কেয়ার উদ্ভাস, ঘরে ঘরে বই পৌঁছে দিতে খুলেছেন ই-কমার্স সাইট রকমারি ডট কম, তৈরি করেছেন গবেষণাগার পাই ল্যাবস, ভিন্ন রকম সফটওয়্যার প্রতিষ্ঠান অন্যরকম সফটওয়্যার।
তিনি একজন আলোর ফেরিওয়ালাও। শিক্ষার্থীদের গণিত শেখানোর কাজেও তিনি অাছেন। বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটির সঙ্গে তিনি সম্পৃক্ত।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন হিটলার এ. হালিম
উদ্যোক্তা_ হতে চাইলেন কেন?
আমি বুয়েটে পড়েছি। একজন প্রকৌশলী হয়ে চাকরি-বাকরি করে আমার জীবন কাটানোর কথা ছিল। কিন্তু আমার আগ্রহ ছিল ‘প্রবলেম সলভ’ করার দিকে। যেহেতু বাংলাদেশে সমস্যা অনেক বেশি তাই উদ্যোক্তার জন্য কাজের সুযোগ অনেক বেশি। আর এত এত সমস্যা পাড়ি দিয়ে আমাদের দেশের লোকজন এগিয়ে যাচ্ছে যে প্রেরণা খুঁজে নেওয়া খুব সহজ।
উদ্যোক্তা হতে চাইলে কোন দিকে ফোকাস করতে হবে বলে আপনি মনে করেন?
উদ্যোক্তা হওয়ার পেছনে আমার ব্যক্তি দর্শন হলো, কী নেই ওইদিকে তাকানো যাবে না। কী আছে ওইদিকে তাকাতে হবে। ‘কী নেই, কী নেই’ চিন্তা করলে তো আমাদের স্বাধীনতাই আসতো না। কারণ, ১৯৭১-এ আমাদের কিছুই ছিল না। শুধু ছিল বঙ্গবন্ধুর ‘যার যা আছে তাই নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ার’ অাহ্বান।
উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য খুবই জরুরি, যা আছে তাই নিয়ে ভাবতে হবে ও এবং ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে।
এ প্রসঙ্গে আমার বন্ধু মাসুম’র গল্পটা বলা যায়। আমরা যে তিন বন্ধু ইভিএম (ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন) বানিয়েছিলাম, মাসুম সেই ৩ জনের একজন। বুয়েটে যখন ভর্তি হয়, তখনও ওর কম্পিউটার ছিল না, অথচ ও প্রোগ্রামিং শিখেছে ক্লাস ক্লাস নাইন/টেনে থাকতে প্রযুক্তি ম্যাগাজিন পড়ে।
স্কুলে থাকতে সাইবার ক্যাফের লোকজনকে অনুরোধ করে মাঝে মাঝে কম্পিউটার ব্যবহার করত। নিজের কম্পিউটার না থাকা এমন একজনের কাছে প্রোগ্রামিং শিখেছি আমিসহ অনেকেই। এরপর গেট-এ-কোডার কাজ (অাউটসোর্সিং) করে ৬০-৭০ হাজার টাকা জমা হলে আমরা একটা কম্পিউটার কিনে আমাদের বন্ধু মাসুমকে দিই। এই গল্পটা আসলে অনুপ্রেরণার।
আমরা কাজ করার আগে চিন্তা করি আমাদের কী কী নেই। কী আছে এটা ভাবি কম। একটা মানুষ যার কম্পিউটার নেই সে প্রোগ্রামিং শিখেছে। সে আউটসোর্স করছে। আউটসোর্সের টাকা দিয়ে সে কম্পিউটার কিনেছে। সাধারণ মানুষ হয়তো চিন্তা করবে, আমার কম্পিউটারই নেই, আমি কিসের আউটসোর্সিং করব? এধরনের অনেক গল্প ছড়িয়ে আছে আমাদের আশেপাশেই।
শুরুটা কেমন ছিল?
আমরা কম্পিউটারে কাজ করি। হলের বন্ধুরা দেখতে শুরু করল আমরা কম্পিউটারে কী করি। তখনও আউটসোর্সিং খুব নতুন আইডিয়া। তারাও চারদিকে গল্প করা শুরু করল, আমাদের বন্ধুরা সফটওয়্যার বানায়। বন্ধুদের আত্মীয়-স্বজন যাদের সফটওয়্যার দরকার এ রকম লিংকে আমরা স্থানীয় কিছু কাজও পেলাম; অ্যাকাউন্টিং সফটওয়্যার, লাইব্রেরি ম্যনেজম্যানন্ট টাইপের সফটওয়্যার তৈরির কাজ।
এভাবে কাজ করে আস্তে আস্তে টাকা জমাতে শুরু করলাম। তারপর এক দুই বছরের মাথায় একটা নামও দিলাম কোম্পানির। তখন নাম দিয়েছিলাম ‘জেরন’। জেরন হচ্ছে জিরো আর ওয়ান মিলিয়ে।
থার্ড ইয়ারে গিয়ে আমরা নামটা পরিবর্তন করি। থার্ড ইয়ারে গিয়ে আমরা যেহেতু ইলেক্ট্রিকক্যালে পড়ি, তো আমাদের ঝোঁকটা ইলেক্ট্রনিকসের দিকে বেশি বাড়লো। তখনও আমাদের (বুয়েটে) মাইক্রোকন্ট্রোলার পড়ায় না। আমরা নেট ঘেঁটে এটা সম্পর্কে জানলাম। নিজেরা নিজেরা শিখে সার্কিট বানানো শুরু করলাম।
ইলেক্ট্রনিকসের আগ্রহ যখন বাড়তে শুরু করলো তখন ইলেক্ট্রনিকসেরও কাজ করা শুরু করলাম বিভিন্ন রকম। তখন আমরা ভাবলাম জেরন নামটা চেঞ্জ করব। আমাদের দেশে তো গবেষণা হয় না। ব্যবসা বলতে আমরা বুঝি মালামাল কিনে বেচে দেওয়া, সওদাগর জাতি তো আমরা!
আমরা ভাবলাম, এমন একটা প্রতিষ্ঠান তৈরি করি যার মূল কনসার্নই থাকবে যে বিভিন্ন রকমের সমস্যা ঘাঁটাঘাটি করে এটার একটা সমাধান বের করা। তখন আমরা কোম্পানির নাম জেরন চেঞ্জ করে নাম দিলাম ‘পাই ল্যাবস’। পাই ল্যাবস নাম দেওয়ার পেছনে অনুপ্রেরণাটা ছিল, বেল ল্যাবস যেমন বিশ্বে বিখ্যাত আমরা বেল ল্যাবস হতে পারি বা না পারি শুরু তো করতে পারি…। বুয়েট থেকে পাস করলাম ২০০৬ সালে।
বুয়েট থেকে যখন বের হলাম তখন বুয়েটের সঙ্গে আমাদের কোম্পানি, পাই ল্যাবস। প্রসঙ্গত, পাই ল্যাবসের কোনও অফিস ছিল না ২০০৬ এর আগে। এর আগে আমরা কাজ করতাম ল্যাব বা বাসা যেখানেই করা যেত আরকি। ২০০৬ এ আমরা প্রথম অফিস নিলাম পুরানা পল্টন মোড়ে। খুবই ছোট্ট ছিল অফিসটা। কাজ করা অনেক আগ থেকে শুরু হলেও ২০০৬ -এ আমাদের উদ্যোক্তা হিসেবে পথচলার আসল শুরু।
উদ্যোক্তা হয়ে ওঠার পেছনের কিছু মজার গল্প যদি বলেন।
আমরা যখন ইলেক্ট্রনিকসের কাজ শুরু করি তখনও আমরা সফটওয়্যারের কাজ করছি, এর মধ্যে একটা মজার স্মৃতি হচ্ছে ইলেক্ট্রনিকসের কাজ শুরু করার কিছুদিনের মাথায় আমরা একটা বিজ্ঞাপন পেলাম যে এক ভদ্রলোক একটা সার্কিট বানাবে, ইন্ডাস্ট্রিয়াল প্রবলেম। উনি লোক খুঁজছেন। আমরা ওই বিজ্ঞাপন দেখে ওনার সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। বড় শিল্পপতি, যুক্তরাজ্যে ছিলেন।
তার সার্কিটটা হলো রি-রোলিং মিলের। এটা অটোমেটেড, যেখানে একটা ভ্যাকুয়াম চেম্বার থাকে, ওখানে প্রেসার অনুযায়ী কয়েকটা ডিভাইসকে অন-অফ করতে হয়। ম্যানুয়ালি করতে গেলে সিঙ্ক্রোনাইজেশন ঠিক মতো হয় না। ফলে কোয়ালিটি ঠিক থাকে না।
আমরা যখন গেলাম তখন তিনি আমাদের দেখে মনে হলো হতাশ হলেন। ভাবলেন হয়তো এরা কেন আমাকে ডিস্টার্ব করতে এসেছে। তবে আমাদের আগ্রহ দেখে ওই ভ্যাকুয়াম চেম্বারের সেন্সরটা তিনি আমাদের দিলেন। দিয়ে বললেন, আপনারা দেখে জানান যে পারবেন কি না। ওখান থেকে আসার পর আমরা ওনার উপেক্ষার বিষয়টাকে জেদ হিসেবে নিলাম। ঠিক করলাম, দেখা দেখি কিছু নাই, আমরা এই ডিভাইস বানিয়েই তার সঙ্গে দেখা করব।
৪ দিনের মধ্যে উনাকে জানানোর কথা আমরা পরে একদিন বাড়িয়ে নিলাম। দিন রাত পরিশ্রম করলাম। আমরা সেটা বানিয়েও ফেললাম। বানিয়ে উনার সঙ্গে দেখা করতে যাওয়ার পরে তিনি বিশ্বাস করতে পারছিলেন না এটা কি। উনি ওখানেই মুখে দিয়ে বাতাস টেনে টেনে চেক করলেন এটা কাজ করছে। বেশ মজা পেলেন মনে হলাে।
তিনি আমাদের কাছে জানতে চাইলেন, এটার দাম কত? আমরা তো কোটেশন দিইনি। জেদ করে বানিয়ে ফেলেছি। সার্কিটের কম্পোনেন্ট যা লাগে নিজেদের পয়সা দিয়েই কিনেছি। টাকা পাব কি পাব না এটা নিয়ে ভাবিনি।
কত জানতে চাওয়ার পর ভয়ে ভয়ে বললাম ২৫ হাজার। তবে, তিনি আমাদের এক লাখ টাকা দিয়েছিলেন। পরে আমরা বুঝতে পারলাম অনেক কঠিন কাজ জেদের চোটে করছি বলে আমাদের গায়ে লাগেনি। ওনার সঙ্গে অনেক দিন সম্পর্ক ছিল আমাদের। তার অনেক প্রজেক্ট আমরা তৈরি করেছিলাম।
আপনার অনেকগুলো কাজের মাঝে একটা হলো ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন। এ সম্পর্কে কিছু বলেন।
কাজ করতে করতে যখন সার্কিট বানানোয় যখন মোটামুটি হাত পাকছে তখন থার্ড ইয়ারেই আমরা ভাবলাম যে আমরা এমন একটা প্রজেক্ট করি যেটা জাতীয়ভাবে একটা বড় অবদান হিসেবে থাকবে। তখনও আইডিয়া ঠিক করিনি যে ইভিএম বা কিছু বানাব। এস এম লুৎফুল কবির স্যারের সঙ্গে আমরা দেখা করলাম। উনি আবার এমন কাজ যারা করেন তাদের খুব উৎসাহ দিয়ে থাকেন। ওনার সঙ্গে বসলাম দুই-তিনদিন ব্রেইন স্টর্মিংয়ের জন্য। পরে আমরা ঠিক করলাম আমরা ইলেট্রনিক ভোটিং মেশিন বা ইভিএম বানাব। এটা ডিসাইড হওয়ার পর স্যার আমাদের একটা ল্যাব সেটআপ করে দিলেন। এটা আমাদের প্রতিষ্ঠানের কোনও প্রজেক্ট ছিল না, প্রফেশনালও না, টাকা পয়সারও কোনোও কিছু ছিল না। জাস্ট স্যার ল্যাব সেটআপ করে দিয়েছেন আমরা আমাদের মত কাজ করেছি।
আনন্দের প্রতিষ্ঠান। অনেক রাত কাজ করেছি। অনেক মজার স্মৃতি ছিল। শুরুর দিকে পিয়নরা আমাদের ওপর খুব বিরক্ত ছিল। কে এলো যে, এদের জন্য বার বার রাত ২টার সময় তালা খুলতে হয়। তারপর আস্তে আস্তে তাদের সঙ্গেও ভালো সম্পর্ক হয়। আমরা সবার কাছ থেকেই সাপোর্ট পাই।
ইভিএম নিয়ে কোন ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা আছে?
ওটা তো রাজনৈতিক ডামাডোলের মধ্যে আটকে আছে। ওটা নিয়ে সহসাই কোনও পরিকল্পনা নেই। আমাদের মূল টার্গেট ছিল বিদেশি মেশিন ঠেকানো। এদেশে যদি কখনও ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন দিয়ে নির্বাচন হয় তবে তা দেশীয় প্রযুক্তি দিয়েই হতে হবে, এটা ছিল প্রাথমিক লক্ষ্য। বিদেশি যারা আমাদের দেশে ইভিএম বিক্রি করতে চায় তারা এরই মধ্যে ৩০ বার ঢাকায় এসেছে, নির্বাচন কমিশনের কাছে প্রেজেন্টেশন দিয়েছে। আমাদের উদ্দেশ্য ছিল, বাংলাদেশে ইভিএম ব্যবহার হলে আমাদের দেশেরটাই যাতে ব্যবহার করা হয়। আমরা তা সফলতার সঙ্গে করতে পেরেছি। আমরা এতে খুশি। ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটি নির্বাচনে আমাদের এই প্রযুক্তি ব্যবহার হয়েছে।
উদ্যোক্তা আর উদ্ভাবক এই দুইয়ের মাঝে আপনি কোথায় দাঁড়িয়ে ?
আমি আগে উদ্যোক্তা, পরে উদ্ভাবক। যেসব উদ্ভাবন আছে সেগুলো আমার উদ্যোক্তা হওয়ার ফল বা আউটকাম। বলতে পারেন দু’টোই সমান্তরালেই চলেছে।
উদ্যোক্তার বিষয়টা হচ্ছে, আমার একটা সমস্যা আছে যেটা আমাকে সমাধান করতে হবে। ছোটবেলা থেকেই নিজে আলাদা কিছু ভাবার চেষ্টা করতাম। সবকিছুর মধ্যেই মনে হতো যা কিছু হয়েছে তার বাইরে তো কিছু করলাম না।
আমাদের দেশে উদ্যোক্তা আর উদ্ভাবককে দুই ভুবনের বাসিন্দা মনে করা হয়। তবে ব্যাপারটা আসলে এমন নয়। উদ্ভাবক বানিয়ে যাবে আর ব্যবসায়ীরা বিক্রি করবে এই ধারণা থেকে বের হয়ে আসতে হবে।
শিক্ষা নিয়ে আপনার একটা প্যাশন আছে। আপনার উদ্যোগগুলোর মাঝে একটা বড় অংশ শিক্ষা নিয়ে? এ বিষয়ে যদি কিছু বলেন।
উদ্ভাসের (একাডেমিক কেয়ার) বিষয়ে বলতে পারি। উদ্ভাস আমি শুরু করি এইচএসসি পাস করে বুয়েটে ভর্তি হওয়ার পর পরই। ওটা আমার উদ্যোক্তা জীবনের সবচেয়ে বড় লড়াই ছিল।
ওটার পেছনে অনেক ইমোশনাল ব্যাপার আছে। আমি তো ছিলাম গ্রামের ছেলে। আমি স্ট্যান্ড করছিলাম গ্রামের স্কুল থেকে। ওখানে একটা বিষয় ছিল, আমার টিচাররা প্রশ্ন করতে বাধা দেয়নি। অনুপ্রেরণা দিত। তবে গ্রামের শিক্ষকরা আমার সব প্রশ্নের উত্তর সবসময় সঙ্গে সঙ্গে দিতে পারতেন না।
ঢাকা কলেজে ভর্তি হয়ে বিখ্যাত টিচারদের পেলাম। কিন্তু সমস্যা হলো যে, প্রশ্ন করলেই তারা খালি ঝাড়ি মারতেন (হাতে গোনা দুই একজন বাদ ছিলেন অবশ্য)। আমি হতাশ হয়ে লেখাপড়ার প্রতি মজাটাই হারিয়ে ফেলি। সেকেন্ড ইয়ারে গিয়ে আমি বিষয়টি কষ্টেমষ্টে কাভার করি এবং আবারও স্ট্যান্ড করি। ওই প্রথম বর্ষের হতাশা থেকেই ভেবেছিলাম আমার এমন একটা প্রতিষ্ঠান হবে যেখানে অন্তত প্রশ্ন করে কেউ ঝাড়ি খাবে না।
হতে পারে আমি প্রশ্নের জবাব দিতে পারব না কিন্তু সে ঝাড়ি খাবে না যে, তুমি প্রশ্ন কেন করেছ? আমার এসব করার কোনও তাড়া ছিল না। আমার পরিবারও স্বচ্ছল ছিল। প্রচলিত শিক্ষাদান প্রথার প্রতি এটা আমার একটা রিপ্লাই ছিল।
নোট গাইড তথা মুখস্থ বিদ্যাভিত্তিক পড়ালেখার বাইরে গিয়ে ‘বুঝে পড়তে হবে’ এই থিমে কাজ করতে গিয়ে কী কী প্রতিবন্ধকতা মোকাবিলা করেছেন?
জমানো ৬ হাজার টাকা দিয়েই শুরু করি। এখন চিন্তা করলে ভয় পাই, তখন এত বড় সাহস আমার কীভাবে হয়েছিল। মানুষের মধ্যে অনেক আবেগ থাকলে সে সাহসী হয়, ভয় লাগে না। একাত্তরেও তাই হয়েছিল। মানুষের মধ্যে এত আবেগ ছিল যে কেউ চিন্তাই করেনি সে মরবে না বাঁচবে। আবেগ থাকলে টাকা কোনও বিষয় না।
টাকা যে আসলেও কোনও বিষয় না তার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা আছে। স্নায়ুবিজ্ঞানীরা বলেন একটা কমপিউটারের সঙ্গে যদি আপনি একটা মানব মস্তিষ্কের তুলনা করেন তাহলে আমাদের মস্তিষ্কের দাম আসে অন্তত পাঁচ হাজার কোটি টাকা। আপনার কাছে যদি পাঁচ হাজার কোটি টাকা থাকে তাহলে আপনার দুই লাখ বা দশ লাখ টাকার শর্টেজ কেন হচ্ছে? যে এই পাঁচ হাজার কোটি টাকা ব্যবহার করে তার কাছে কিছুই আটকায় না। আর যে এটা ব্যবহার করতে পারে না তাকে পঞ্চাশ লাখ কেন, পঞ্চাশ কোটি টাকা দিলেও সে কিছু করতে পারবে না।
আমার এক বন্ধু দিল ছয় হাজার আর আমার ছয়। সব মিলিয়ে ১২ হাজার টাকা দিয়ে শুরু করলাম উদ্ভাস। আমাদের উদ্ভাস লাভের মুখ দেখেছে সপ্তম বছরে গিয়ে। এটা একটা কঠিন লড়াই ছিল। যা ছিল কল্পনাতীত।
একটা বিজনেস যদি কেউ দেয়, সে লসে কত বছর চালাবে? আমাদের সঙ্গে উদ্ভাস শুরু করার পর আরও দুইজন যুক্ত হয়ে মোট চারজনের টিম হয় যাদের দুই জন সাড়ে পাঁচ বছরের মাথায় ছেড়ে চলে গেছে। বলেছে, এসব দিয়ে হবে না। বাংলাদেশের লোক নোট-গাইডের বাইরে কিছু বুঝবে না। কিন্তু আমরা প্রথম দিন থেকেই একই নীতিতে আছি। আমরা কোনও নোট দিই না, সাজেশন দিই না। বলি, বুঝে পড়তে হবে। নোট দিলেই কিন্তু ছেলেপেলেরা চলে অাসে। কিন্তু আমরা দিইনি।
আমরা প্রচলিত ধারার বাইরে, কোচিং সিস্টেমের বিরুদ্ধে। এ কারণেই মানুষকে বোঝাতে অনেক সময় লেগেছে।
উদ্ভাসের উদ্দেশ্য কী?
যোগ্য মানুষের চারটি বৈশিষ্ট্যকেই আমরা হাইলাইট করি। এক, চিন্তা করার ক্ষমতা; দুই, লেগে থাকা; তিন, আত্মবিশ্বাস এবং চার, মূল্যবোধ বা ভালমন্দ বুঝে ভালোটা করতে চাওয়া। উদ্ভাস একটা পরীক্ষার গ্রাউন্ড। যে পদ্ধতিতে এগুচ্ছে তা অনেকেই গ্রহণ করেছেন। অল্প হলেও তাদের মধ্যে একটা পরিবর্তন আসছে। মুখস্থবিদ্যার পরিবর্তে বুঝে পড়া।
তাহলে প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থায় সমস্যা আছে, বলতে চাচ্ছেন?
আমাকে যদি কেউ জিজ্ঞাসা করে আমাদের দেশের শিক্ষা কী কার্যকর? আমি বলি, না।
এটা কী অকার্যকর? আমি বলি, না।
তাহলে কী?
আমি বলি এটা ‘কুকার্যকর’।
‘কুকার্যকর’ কারণ আমাদের ছেলেমেয়েরা অসম্ভব ট্যালন্ট নিয়ে জন্ম নেয়, আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা অনেক ক্ষেত্রেই সিম্পলি এটাকে ধ্বংস করে দেয়।
স্কুলের কাজ হচ্ছে যোগ্য মানুষ তৈরি করা। যোগ্য মানুষ কাকে বলে তাহলে? যোগ্য মানুষ হতে হলে অন্তত চারটা গুণ থাকতে হবে। এই চারটি গুণ হলো: এক, চিন্তা করার ক্ষমতা; দুই, লেগে থাকা; তিন, আত্মবিশ্বাস এবং চার, মূল্যবোধ বা ভালমন্দ বুঝে ভালোটা করতে চাওয়া। প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা এগুলো তৈরি করা তো দূরের কথা, অধিকাংশ ক্ষেত্রে এগুলো ধ্বংস করে দিচ্ছে।
আপনার বেশিরভাগ উদ্যোগের প্রযুক্তি ঘনিষ্ঠতা অনেক বেশি। এর কারণ কী?
কারণটা সম্ভবত একাডেমিক। বুয়েটে পড়ার সুবাদে হয়তো এমনটা হয়েছে। সমস্যা মাথায় এলে সমাধান খুঁজতে গেলে প্রথম আইটিই মাথায় আসত। একটা সময় পর্যন্ত সবাই হয় বুয়েট, নয় তো মেডিকেলে যেতে চাইত। আমি যেহেতু জীববিজ্ঞান পড়িনি, তাই মেডিকেলের অপশন আমার ছিল না। বুয়েটে পড়লাম। তারপর যখন সমস্যা মাথায় আসা শুরু করলো তখন সমাধান খুঁজতে গেলে আইটিই মাথায় আসে সবার অাগে।
আপনার উদ্যোগগুলোর মাঝে ‘রকমারি ডট কম’ এর মাঝে বেশ পরিচিত? এর গল্পটা কেমন?
ছোটবেলা থেকেই প্রচুর বই পড়তাম, এখনও পড়ি। বই পড়া আমার নেশার মত। এটা আমাকে স্থির হতে সহায়তা করেছে। প্রচুর পেপারও পড়তাম একটা সময়।
রকমারির নামের সঙ্গে লং টার্ম মিশনের মিল আছে। আমরা একসময় বিভিন্ন পণ্য নিয়ে কাজ করব। তবে শুরুটা বই নিয়ে করেছি। রকমারি থেকে যে কেউ বাংলাদেশের যে কোনও প্রান্তে বসে যতগুলো খুশি বই কিনতে পারে মাত্র ৫০ টাকা সার্ভিস চার্জে।
আমরাই বাংলাদেশে ক্যাশ অন ডেলিভারি মানে পণ্য হাতে পেয়ে টাকা পরিশোধের মডেল চালু করি। শুরুতে এ নিয়ে বেশ হাসাহাসি হয়েছিল। তবে আপনি আপনার গ্রাহককে বিশ্বাস না করলে গ্রাহক কেন আপনাকে বিশ্বাস করবে?
আমাদের দেশে নতুন শিল্প গড়ে উঠছে না কেন? কী কী প্রতিবন্ধকতা আছে বলে আপনার মনে হয়?
করণীয় হচ্ছে, কয়েকটা ভালো উদাহরণ তৈরি করা। আমরা হুজুগে জাতি, কেউ একজন করলে তা ধীরে ধীরে সবাই করতে শুরু করবে। এটার খুব শক্ত উদাহরণ আমাদের সামনেই আছে এখন, বর্তমান ই-কমার্সের জোয়ার।
আসলে একটা শিল্প গড়ে ওঠার জন্য একটা পারিপার্শিকতার দরকার হয়। যা এতোদিন ছিল না এখন আস্তে আস্তে তৈরি হচ্ছে।
এছাড়া এক ধরণের পদ্ধতিগত ভুল আছে। যেমন, আমাদের দেশে আইপিএস ও ইউপিএস শিল্প ধীরে ধীরে কুটির শিল্পের মতো এগোচ্ছিল। পরে কী হলো, আইসিটিকে ব্যাকআপ দেওয়ার জন্য সরকার আইপিএস, ইউপিএসের ওপর থেকে ট্যাক্স কমিয়ে দিল। ফলে চীনা পণ্য বাজার দখল করে নিল। চাইনিজটা সস্তা হয়ে যাওয়াতে লোকাল ফিনিশিং-এর পণ্যের বিক্রি কমে গেল। আমাদের কুটির শিল্পটা ধ্বংস হয়ে গেল।
তবুও আমি এটাকে সমস্যা মনে করি না। আসলে সাহস ও যোগ্য মানুষের অভাব রয়েছে। কেউ একজনকে স্টার্ট করতে হবে। কারণ একজন আমেরিকানের চাইতে আমাদের বুদ্ধিমত্তা অনেক বেশি। আমাদের যে শিক্ষা ব্যবস্থা তার মধ্যেও যে এতো ভালো কিছু হচ্ছে কারণ আমাদের ক্রাইসিস রয়েছে। যেমন, আমেরিকাতে একজন মানুষকে গাড়ি চালাতে হলে কী করতে হয়? সবুজ বাতি, লাল বাতি শিখতে হয়, সবুজ বাতি দেখলে চলে যেতে হয়, লাল বাতিতে থামতে হয়।
আর আমাদের দেশে প্রতি মুহূর্তে একজন ড্রাইভারকে শ’খানেক ক্যালকুলেশন করতে হয়। আমরা ক্রাইসিসের মধ্যে দিয়ে বড় হই বলে আমাদের অনেক বেশি যোগ্যতা তৈরি হয়। এর সঙ্গে শিক্ষা পদ্ধতিটা আর একটু ভালো হলেই আমরা যে কোথায় চলে যেতাম আমরা নিজেরাই জানি না।
আমাদের দেশের তরুণরা কী আইটি শিক্ষাবিমুখ?
আসলে ওভারঅল বিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহ কমে গেছে। কারণটা হচ্ছে, মানুষ এখন শর্টটার্ম চিন্তা বেশি করে। তার ওপর আর্টস, কমার্সের চাকরি এখন অনেক চাকচিক্যময়।
এদিকে আমাদের দেশ কিন্তু বিজ্ঞানে পড়া লোকজন চালাচ্ছে না। তাই সায়েন্স বা বিজ্ঞানে পড়ে করবে কী? অন্য দিকে চলে যাক। সায়েন্স পড়া অনেকেই কিন্তু দেশে থাকছে না। এর কারণ কিন্তু শুধুমাত্র টাকা না। প্রথম কারণ হচ্ছে সে গ্রাউন্ড চায়, সে যা শিখেছে তা প্রয়োগ করার গ্রাউন্ড। আর আমাদের এখানে তো কোম্পানিই নেই যারা স্থানীয়ভাবে গবেষণা করে। তারা তাদের বুদ্ধিমত্তাটা খাটাবে কোথায়? অনেকেই চায় কিন্তু, আমাদের ফ্রেন্ডদের মধ্যেই অনেকে চায় টাকা পয়সা কম হলেও দেশেই থাকতে।
এখনও কি সরাসরি ল্যাবে রিসার্চ বা নতুন আইডিয়া নিয়ে কাজ করেন?
সরাসরি রিসার্চ করা হয় কম। নিজ হাতে কোড লেখা, সার্কিট ডিজাইন এসব অনেক আগেই বন্ধ হয়ে গেছে। তবে যখন আমাদের কিছু নিয়ে গবেষণা হয় আর অ্যালগোরিদমে কোনও সমস্যা দেওয়া যায় তখন সেটাতে অংশ নিই।
তার চেয়ে রিসার্চের নতুন সুযোগ সৃষ্টি করে দিতে চাই। আরেকটা জিনিস আমাদের দেশে বিরল, একাডেমি ও ইন্ডাস্ট্রি নিয়ে এক সঙ্গে কাজ করা। ইন্ডাস্ট্রিতে যে সব নিয়মিত সমস্যা দেখা যায় একাডেমিক এরিয়া থেকে তার সমস্যা বের করে আনা। এতে ইন্ডাস্ট্রি ও একাডেমি উভয়ই উপকৃত হবে। সারা বিশ্ব এভাবেই চলছে, অথচ আমরা এখানে নজর দিচ্ছি না। রিসার্চের এই জায়গা নিয়েও কাজ করছি। আর আইডিয়া নিয়ে নিয়মিত কাজ করা হয়।
আমাদের দেশে বিরাজমান বিশাল ডিজিটাল বৈষম্য দূর করতে আপনার কোনও উদ্যোগ আছে কী?
দেশে বিরাজমান বিশাল ডিজিটাল বৈষম্য’ টার্মটা নিয়ে আমার আপত্তি আছে। আসলে আমাদের যে ধরণের উদ্যোগ তার মধ্যে এটা পড়ে না। আমি এসব কথা প্রমোট করতে রাজি না। নেগেটিভ কথা বলা মানে মানুষকে বিপথে চালনা করা।
গ্রামের মানুষকে এটা বললে তারা ভাববে, আমাদের তো এই সুবিধা নেই, তাই আমার এগোনোর আর কোনও অপশন নেই। যা আছে এটা নিয়েই সুখী। এটাই হওয়া উচিত, মাইন্ড সেট। যা আছে তা থেকেই ভালো কিছু বের করে আনতে হবে। আমরা যখন গেট-এ-কোডার’র কাজ করেছি তখন ইন্টারনেটের গতি কত ছিল? এটাকে হাইলাইট করার কোনও কারণ নেই। এতে মানুষের মন ভেঙে যেতে পারে।
কেমন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেন?
এককথায় বললে সুখী বাংলাদেশ। আমার কাছে সফলতার মানে হচ্ছে সুখী থাকা। ব্যক্তিগতভাবে সুখের জন্য প্রচুর ধনী হওয়া বা ক্ষমতা থাকা জরুরি নয়।
রাষ্ট্রীয়ভাবেও সুখী হতে গেলে সমৃদ্ধ বা সম্পদশালী হলে তা বাড়তি মাত্রা যোগ করে। তবে সমৃদ্ধ হওয়া অত্যাবশ্যকীয় নাও হতে পারে। আসলে প্রশ্ন হচ্ছে, আমাদের সামনে যারা আছে বা যাদের আমরা মডেল হিসেবে নিচ্ছি সেখানে লোকজন শান্তিতে আছে কি না।
উন্নত বিশ্বে যে ঔষধটা সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয় সেটা ঘুমের ঔষধ। জনে জনে বাড়ি, গাড়ি, তাহলে ঘুমাতে পারে না কেন? আমাদের দেশে একজন রিকশাওয়ালা দেখবেন রিকশার মধ্যে কাত হয়ে সুন্দর ঘুমিয়ে পড়েছে। আমাদের মধ্যে যে বন্ধন আছে, মানুষ মানুষকে যেভাবে অনুভব করে সেটা ওখানে নেই।
শংকরের একটা বই আছে, ‘যস্মিন দেশে যদাচার।’ ওখানে একটা কাহিনী আছে যে, প্রথম বিশ্বের এক দেশে এক ছেলের মা খুব খুশি। কারণ সে তার ছেলের বাসায় ভাড়া থাকে এবং ছেলে তাকে ১০ ভাগ ছাড় দিয়েছে। ওরা এমন সমাজ নির্মাণ করেছে। আমরা কী সেদিকে এগুতে চাই? আমি এমন সমৃদ্ধ হতে চাই না। তার চেয়ে শুধু সুখী বাংলাদেশ হলেই আমি বেশি খুশি।
কী কী থাকলে সুখী হওয়া যায়?
সুখের বিষয় বলতে গেলে, বস্তু আপনাকে কখনওই সুখ দিতে পারবে না। আপনার যা’ই থাক না কেন। সুখ শুধুমাত্র একটা ওয়েতেই হয়। সেটা হচ্ছে ঠিকভাবে চিন্তা করতে শেখা।
প্রতিযোগী মনোভাব কমাতে হবে। যেমন, মিরপুরের দুয়ারিপাড়া বস্তিতে আমাদের একটা স্কুল অাছে। ওই স্কুলে আমরা একে একে পরীক্ষা তুলে দিচ্ছি, বিভিন্ন রকম প্রতিযগিতা বন্ধ করে বাচ্চাদের একে অন্যকে সহযোগিতা যাতে করতে শেখে, সেটা শেখানোর চেষ্টা করছি। সহজ কথায় হলো, সুখী হতে হলে চিন্তা করার প্রক্রিয়াটা পাল্টাতে হবে।
সময় দেওয়ার জন্য অাপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
মাহমুদুল হাসান সোহাগ: বাংলা ট্রিবিউনকে শুভেচ্ছা। তরুণদের মুখপত্র হোক বাংলা ট্রিবিউন। (লিখন: এম. এম. রহমান-বাংলা ট্রিবিউন)
সংগৃহীত: বাংলা ট্রিবিউন ডটকম।
Valo post
Nice post
Esto — es imposible.
Anonymous links