সময়টা ১৯৯৪ সাল। জাস্টিন হল আমেরিকার শিকাগোর ১৯-২০ বছরের এক তরুন Justin’s Links from the Underground নামে একটি ওয়েবসাইট চালু করে। এখানে সে বিভিন্ন ওয়েবসাইটের লিংক দিয়ে যেত। তারপর একসময় নিজের প্রাত্যহিক জীবনের কথা লিখে যেত ডায়েরীর মত। এভাবে পার্সোনাল বা ব্যক্তিগত ব্লগিং এর সুচনা ঘটে। জাস্টিন হল এর সেই ওয়েবসাইট আজো আছে
এর পর ৪-৫ বছর ধরে আস্তে আস্তে পার্সোনাল ব্লগিং এর প্রসার ঘটতে থাকে। কয়েকটা কোম্পানি বুঝতে পারে যে এদিকে মন দেয়া দরকার এবং তারা মানুষ যাতে সহজে ব্লগিং করতে পারে এমন প্রযুক্তি তৈরি করা শুরু করে। ১৯৯৮ সালে এল ওপেন ডায়েরী (২০১৪ সালে অর্থের অভাবে তা বন্ধ হয়ে যায়) এবং একসময় এতে ৭৭ টি দেশের সাড়ে ৫ লক্ষের মত লোক ডায়েরী লিখত। ১৯৯৯ সালে ব্লগার (২০০৩ সালে গুগোল এটি কিনে নেয়) এবং লাইভ জার্নাল শুরু হয়। এ দুটো ব্লগিং প্লাটফর্ম এখনো বেশ জনপ্রিয়। ২০০১ সাল পর্যন্ত মূলত ব্লগ বলতে অনলাইন ডায়েরী হিসেবেই মানুষ বেশি চিনত। ২০০১-০২ থেকে রাজনীতি নিয়ে ব্লগ জনপ্রিয় হতে থাকে যুক্তরাষ্ট্রে।
ব্লগের এই জনপ্রিয়তাকে কেন্দ্র করে আস্তে আস্তে বিভিন্ন বিষয়ের উপর ব্লগ চালু হতে থাকে। Weblogs Inc. ও ১৯৯৪ সালে Gawker Media- এ দুটি ব্লগ নেটওয়ার্ক কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করা হয় টাঁকা আয়ের বা মুনাফার আয়ের উদ্দেশ্য নিয়ে। এ দুটি ব্লগ নেটওয়ার্ক এখনো টিকে আছে এবং বেশ ভালই টাঁকা কামাচ্ছে। ২০০৫ সালের অক্টোবর মাসে আমেরিকার অন্যতম বড় প্রযুক্তি কোম্পানি AOL প্রায় ২৫ মিলিয়ন ডলার (এখনকার ডলারের মুল্যে ২০০ কোটি টাঁকা) Weblogs Inc. কে কিনে নেয় এবং এরপর শুরু হয় আমেরিকা, ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়াতে ব্লগ নেটওয়ার্ক ও পেশাদারী ব্লগিং এর হুজুগ। ব্লগ নেটওয়ার্ক মানে হল এক সঙ্গে বেশ কয়েকটি (৫-১০ টি হতে পারে বা ১০০ এরও বেশি হতে পারে) ব্লগ পরিচালনা করা।
২০০৬-০৭ সালে বানিজ্যিক ব্লগের ধুম নিজের চোখে দেখেছি। তখনো ফেইসবুক বা টুইটার তেমন জনপ্রিয় নয়। গুগোল এডসেন্স, চিটিকা প্রভৃতি অনলাইন বিজ্ঞাপন আসলো ২০০৩-০৪ সাল থেকেই যাতে করে ব্লগাররা সহজে টাঁকা আয় করতে পারে। ২০০৭ সাল পর্যন্ত লক্ষ লক্ষ লোক (আমাদের দেশের শেয়ার বাজারের মত) ব্লগ খুলে ফেলেন টাঁকা আয়ের সপ্ন নিয়ে। খুব বেশি ব্লগার সফল হয়েছেন তাও নয়।আবার যারা সফল হয়েছেন তাদের কেউ কেউ শূন্য থেকে মিলিয়নার বা কোটিপতি হয়েছেন।
২০০৮ সালে আমেরিকা ও ইউরোপ তথা সারা বিশ্বের অর্থনীতিতে শুরু হল ভয়াবহ মন্দা এবং এর ফলে ব্লগারদের আয় কমতে থাকল বা আগের মত অত সহজে টাঁকা আয় করা আর যাচ্ছিল না। একই সঙ্গে ফেইসবুক ও টুইটার জনপ্রিয় হতে থাকে। ফলে অনেকেই ব্লগিং এ সময় না দিয়ে ফেইসবুকে ও টুইটারে আসক্ত হতে থাকেন।
২০০৯-১০ এ এসে দেখা গেল অনেক জনপ্রিয় ব্লগ নেটওয়ার্ক হয় ব্লগের সংখ্যা কমিয়ে ফেললো না হয় ব্লগ নেটওয়ার্ক বন্ধ করে দিতে বাধ্য হল অর্থনৈতিক মন্দার কারণে। এদের মধ্যে b5media ও Know More Media Network অন্যতম।
ফেইসবুক ও টুইটারকেও কিন্তু ব্লগের সংজ্ঞার মধ্যে আনা যায়। এদের মাইক্রোব্লগিং হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। তাই ব্লগ এখন মাল্টি বিলিয়ন ইন্ডাস্ট্রি। একদিকে ব্লগাররা আয় করছেন, ব্লগ কোম্পানিগুলো (ব্লগ নেটওয়ার্ক) আয় করছে, ডোমেইন হোস্টিং কোম্পানি, ফেইসবুক, টুইটার, ব্লগার, ওয়ার্ডপ্রেস এর মত প্লাটফর্ম কোম্পানি গুলো আয় করছে। এ লেনদেনের পরিমান প্রতি দিনই বাড়ছে। গুগোল, ফেইসবুক তো বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ কোম্পানি হয়ে গেছে ব্লগিং এর জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগিয়ে।
পার্সোনাল ব্লগিং এখনো টিকে আছে এবং বেশ জনপ্রিয়ভাবেই টিকে আছে। সামুতে আমরা কমিউনিটি ব্লগিং করছি। বানিজ্যিক ব্লগের প্রসারও থেমে নেই বরং আরও বেশি প্রসার হবে আগামি দিনগুলোতে। বাংলাদেশেই আগামি ৫ বছরের মধ্যে প্রতিটি মাঝারি ও বড় কোম্পানি ব্লগ ও ফেইসবুকের জন্য বেতন দিয়ে লোক রাখবে। ২০১৯ সালের নির্বাচনে অন্তত বড় দুটি রাজনৈতিক দলের ৩০০ করে ৬০০ প্রার্থীর প্রত্যেকেই ওয়েবসাইট, ফেইসবুক, ব্লগ এসবের পেছনে ভাল অর্থ ব্যয় করবে তা এখন থেকেই বুঝতে পারছি। রাজনীতি নিয়ে ব্লগের ভবিষ্যৎ সারা বিশ্বেই উজ্জল। ইন্টারনেট ব্যবহার যত বাড়বে ততই রাজনীতি নিয়ে ব্লগে লেখক ও পাঠক দুইই অনেক বাড়বে।
টাঁকা আয়ের জন্য ব্লগিং করা হুজুগ কিছুটা কমলেও আবার তা ফিরে আসবে বলেই আমার মনে হয়। আমেরিকা আর ইউরোপের অর্থনীতিক মন্দার খারাপ সময় প্রায় কেটে গেছে বা অন্তত সবচেয়ে খারাপ অবস্থা এখন আর নেই। তাছাড়া তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে ব্লগিং এর ঢেউ শুরু হচ্ছে একটু একটু করে। এখনো বিশ্বের অর্ধেকের বেশি মানুষ ইন্টারনেটের বাইরে। বাংলাদেশে এখনো ২৫% মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহার করেনা। নিয়মিত (প্রতিদিন) ইন্টারনেট ব্যবহার করে এমন মানুষের সংখ্যা ১০% হবে কিনা আমার সন্দেহ আছে। অনেক লোক আছেন যাদের কাছে ইন্টারনেট মানে হল ফেইসবুক বা গান ও মুভি ডাউনলোড করা।
বাংলাদেশে অনলাইনে এখন ফেইসবুকের একচেটিয়া রাজত্ব। প্রায় ১ কোটির মত একাউন্ট রয়েছে। তবে ব্লগের ভবিষ্যৎ আমার কাছে অনেক বেশি উজ্জল বলে মনে হয়। হয়তো সংখ্যার দিক দিয়ে ফেইসবুক আগেই থাকবে কিন্তু মানের দিক থেকে ব্লগ অনেক এগিয়ে যাবে। আমার এ ধরনের আশাবাদের কারণ রয়েছে এবং আগামীতে কোন এক পোস্টে এ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার আশা রাখি।
Courtesy: Razib Ahmed