চায়ের দোকানে বসে গল্প করছিলাম একজন বয়স্ক প্রাইভেট কার চালকের সাথে। কথায় কথায় আড্ডা জমতেই বুঝতে পারলাম ভদ্রলোকের কাছ থেকে কিছু শিখতে পারব। আরও সহজ সান্নিধ্য পাবার চেষ্টা চলতে না চলতেই অন্দর মহলে ঢুকে পড়লাম আমি। ব্যাক্তিগত নানান কথা বলতে শুরু করলেন তিনি। এক পর্যায়ে আড্ডা পেল তুমুল গতি আর আমিও আমার কাংখিত লক্ষের খুব কাছাকাছি চলে আসতে পারছিলাম। চলুন তাহলে শুরুটা করি….
সে অনেক আগের কথা। আমার স্যার যার গাড়ি আমি আজ পয়ত্রিশ বছর ধরে চালাই, তার বড় হওয়া আমি চোখের সামনে দেখেছি। যখনের কথা বলছি তখন মাত্র তিন বছরের একটু বেশী হবে স্যারের গাড়ি আমি চালাই। স্যারের তখন বেশকিছু ছোট ব্যবসা ছিল। তা স্যার বেশ কষ্ট করেই করেছিলেন। একদিন সকালে স্যার আমাকে বললেন কাল খুব সকালেই বের হব। তুমি তৈরী থেক।
আমি ফজরের নামাজ শেষে খুব সকালে প্রস্ততি নিয়েই গাড়ি রেডী করে রাখলাম। স্যারও ভোরের আলো বের হতে না হতেই চড়ে বসলেন। আমাকে নির্দেশনা দিয়েে এগিয়ে যেতে যেতে বলতে শুরু করলেন অনেক দুরের গ্রাম্য পথে যাব। রাস্তায় নাশতা সেরে নিব। তোমার ক্ষুধা লাগলে কোন একটা বাজারে খাবারের হোটেল দেখলে গাড়ি থামিয়ে দিও। একটা বিষয় বলে রাখি আমার স্যার খুব ভাল মানুষ আর আমাকে খুব বিশ্বাসও করেন।
স্যার আমার কাছে তার ব্যবসার বিষয়ে মাঝে মধ্যেই ভাল মন্দ শেয়ার করতেন। স্যার ওই দিন আমাকে বলছিলেন আজ যে জায়গাতে যাচ্ছি সেখান পর্যন্ত গাড়ি নাও যেতে পারে। স্যার পিছনে বসে একটা ম্যাপ খুব মনযোগ সহকারে দেখছিলেন। আমি বার কয়েক লুকিং গ্লাসে দিখেছিলাম স্যারের হাতের কাগজে খুব মনযোগ। যেখানটাতে স্যার গাড়ি থামানোর নির্দেশনা দিলেন সেখানটা হাইওয়ে থেকে বেশ ভিতরের একটা কাঁচা রাস্তায়। আমাদের গাড়িটা পাশেই একটা বাড়ির ভেতরে রাখলাম।
গাড়ি রেখে স্যার আমাকে সাথে নিয়ে হেঁটেই রওনা হল। যেখানটাতে গাড়ি রেখেছিলাম সেখান থেকে আমাদের সাথে আরও এক ব্যক্তি যুক্ত হল। স্যারের খুব বেশী পরিচিত বলেও মনে হল না। একটি গরুর গাড়ি ভাড়া করা হল। গাড়িয়াল সহ চারজনের যাত্রা আরও ঘন্টা খানেক। গরুর গাড়ির চালককে একজায়গাতে থামানো হল। এবং বলা হল ওই স্থানেই থাকতে যাতে আমরা তার গাড়িতে করেই ফিরতে পারি। সূর্য তখন মাথার ওপর প্রখর তাপ দিয়েই যাচ্ছে।
হাটতে হাটতে স্যার মাঠের মধ্যে নেমে পড়লেন সাথে যুক্ত হওয়া নতুন লোকটির নির্দেশনায়। লোকটির হাতে জায়গা জমি মাপার কাজে ব্যবহৃত বিশেষ লম্বা একটি ফিতা ছিল। মাঠের আইল ধরে হাটতে হাটতে একটা খাল পাড়ে এসে থামলাম। খালটা ডিঙি নৌকায় পাড়ি দিয়ে আরও কিছু দুর হেটে গিয়ে বিশাল কয়েক খন্ড জমির কাছে এসে থামলেন। হাতের ম্যাপটি আবারও ভাল ভাবে দেখে নিলেন। এবার লোকটিকে জমি মাপার নির্দেশনা দিতে শুরু করলেন। স্যারের দিকে আমি উজ্বল দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে ভাবতে শুরু করলাম টাকা হলে মানুষ পাগলও হয়ে যায়। নাহলে কি জমি কিনতে এখানে কেউ আসে। এখানে তো আমার মনে হয় শেয়াল কুকুরও আসেনা। স্যার আসছে এইখানে জমি কিনতে।
স্যার ওই জমিতে ঠিকই বিনিয়োগ করলেন। ফেরার পথে আমি স্যারকে গাড়িতে বসে জিজ্ঞাসা করলাম স্যার আপনি কি দেখে এই জমি টাকা দিয়ে কিনলেন। স্যার উত্তরে আমাকে বলেছিলেন তোমার জমানো টাকা থাকলে কিছু জমি কিনে রাখ এখানে। আফসোস হয় সেদিনের জন্য। আমি বোকার মত বলেছিলাম স্যারকে আমি কষ্ট করে টাকা কামাই। এইখানে এসে কোন দিন থাকব না। এইখানে জমি দিয়ে আমার কোন লাভ নাই। আপনার টাকা আছে আপনি রাস্তা ছাড়া পানির মধ্যে জমি কেনেন।
জমি কেনার এগার বছর পর ঠিক সেই জমির পাশদিয়ে আশি ফুট চওড়া পিচঢালা হাইওয়ে রাস্তা হয়েছে। স্যারের জমিতে বিশাল প্রেট্রোল পাম্প হয়েছে। সেই সাথে পেট্রোল পাম্পকে কেন্দ্র করে জমজমাট হোটেল রেস্তারার ব্যবসা। যেখানে শেয়াল কুকুর পা দিত না সেখানে হাজার হাজার মানুষের পদচারণা। সবই আমার চোখের সামনে হয়েছে। সেদিন স্যারের কথার দাম দেইনি। আজ আফসোস করি। সুযোগ সব সময় আসে না। স্যারের এক বন্ধু পরিকল্পনা মন্ত্রনালয়ে চাকুরী করেন। তার সুত্র ধরেই পরামর্শক্রমে স্যার এই পরিকল্পনা করেছিলেন।
গল্পটার শিক্ষাটা বলতে চাই, সুদূরপ্রসারী চিন্তা করুন বড় কিছুর জন্য ধৈর্য্য ধরুন। সিদ্ধান্তের ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে তবেই লক্ষের দিকে এগিয়ে যান। সফলতা শুধু সময়ের ব্যাপার মাত্র।
মাকসুদা আক্তার তিন্নী
Posted in: Diamu Blog
Date: 24 february 2018
nice